সমগ্র বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত অগণিত অ্যান্ড্রয়েড(Android) স্মার্টফোনের সাহায্যে গঠিত গুগলের Android Earthquake Alert System (AEA) এখন এমন একটি প্রযুক্তি হিসেবে পরিচিত, যেটা ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগেই মানুষের কাছে সতর্কতা পাঠাতে পারে। বিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন, এটি শুধু কার্যকরই নয়, বরং প্রচলিত ব্যয়বহুল ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার চেয়েও অনেক বেশি সাশ্রয়ী এবং কার্যকর।
মূলত এই প্রযুক্তিটি ২০২৩ সালে ভারতের মতো জনবহুল দেশে চালু হয়। ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর জন্য গুগল সর্বপ্রথম ২০২০ সালে এই ব্যবস্থা চালু করে । লক্ষ্য ছিল – স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের আগে থেকেই সতর্ক করা, যাতে তারা নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারেন বা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রাথমিক পদক্ষেপ নিতে পারেন।
পুরো পৃথিবীর ৯৮টির বেশি দেশে বর্তমানে এই অ্যান্ড্রয়েড ভিত্তিক ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। অবাক করার বিষয়, তিন বছরে এই সিস্টেমটি ২৫০ কোটি মানুষকে কভার করেছে। এটি একটি বিশাল অগ্রগতি, বিশেষ করে যখন ভাবা যায় – এমন কোনো আলাদা ভূকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ছাড়াই সাধারণ মানুষের হাতের স্মার্টফোনই এখন এই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সিস্টেম কীভাবে কাজ করে?
গুগলের একটি ব্লগ পোস্ট অনুযায়ী, স্মার্টফোনে থাকা অ্যাকসেলেরোমিটার সেন্সর এমন এক ধরনের সেন্সর যা কম্পন বা নড়াচড়া শনাক্ত করতে পারে। প্রতিটি অ্যান্ড্রয়েড(Android) ফোনেই এই সেন্সর থাকে। যখন একটি ফোন অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে ওঠে – যেমনটি ভূমিকম্পের সময় হয় – তখন সেটি একটি সিগন্যাল পাঠায় গুগলের ভূমিকম্প শনাক্তকরণ সার্ভারে।
মূলত সিগন্যালের সাথে থাকে কম্পনের সময় ও অবস্থানের তথ্য। একাধিক ফোন যদি কাছাকাছি একই রকম কম্পনের তথ্য পাঠায়, তখন গুগলের সার্ভার নিশ্চিত হয় যে আসলেই ভূমিকম্প হয়েছে বা হচ্ছে। তখনই আশেপাশের ব্যবহারকারীদের সতর্কবার্তা পাঠানো হয়।
এইভাবে, বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটির বেশি অ্যান্ড্রয়েড ফোন যেন পরিণত হয়েছে ছোট ছোট ভূমিকম্প ডিটেক্টরে। বিজ্ঞানীরা এটিকে বলছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প সতর্কতা নেটওয়ার্ক।
বিজ্ঞানীরা কী বলছেন এই প্রযুক্তি নিয়ে?
Science নামক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই Android Earthquake Alert System প্রচলিত সিসমিক পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্কের মতোই নির্ভরযোগ্য। গবেষণার ভাষায়, “AEA প্রমাণ করেছে যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা স্মার্টফোনগুলো ব্যবহার করে ভূমিকম্প শনাক্ত ও সতর্কতা প্রদান করা সম্ভব এবং তা এতটাই কার্যকর যে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সমতুল্য।”
গবেষণায় আরও বলা হয়, যদিও স্মার্টফোনের সেন্সরগুলো উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সিসমিক যন্ত্রপাতির মতো সংবেদনশীল নয়, তবুও এগুলো ভূমিকম্পের প্রাথমিক সংকেত শনাক্ত করতে যথেষ্ট সক্ষম। সঠিকভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে গুগলের সার্ভার যেভাবে কাজ করে, তা এই ব্যবস্থাকে অসাধারণ কার্যকর করে তুলেছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
গবেষণাটি জানায়, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গুগলের এই AEA ব্যবস্থা ৯৮টি দেশে মোট ৩১২টি ভূমিকম্প শনাক্ত করেছে, যেগুলোর মাত্রা ছিল ১.৯ থেকে ৭.৮ পর্যন্ত। এত বড় পরিসরে সাধারণ ফোনের মাধ্যমে এমন সতর্কতা প্রদান প্রযুক্তিগত দিক থেকে এক বিশাল অগ্রগতি।
প্রাপ্ত ডেটা অনুযায়ী, যেসব ব্যবহারকারী ভূমিকম্প সতর্কতা পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ ব্যক্তি প্রকৃত কম্পন অনুভব করেছিলেন। এর মধ্যে ৩৬ শতাংশ বলেছেন, তারা ভূমিকম্প শুরুর আগেই সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন। ২৮ শতাংশ সতর্কতা পান ভূমিকম্প চলাকালীন, আর বাকি ২৩ শতাংশ সতর্কতা পেয়েছিলেন যখন ভূমিকম্প ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।
প্রযুক্তির ভিজ্যুয়াল ব্যাখ্যা
গুগল একটি এনিমেশনের মাধ্যমে দেখিয়েছে, তুরস্কে একটি ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্পের সময় কীভাবে ফোনগুলো পর্যায়ক্রমে কম্পন শনাক্ত করেছিল। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, হলুদ রঙের ডটগুলো হচ্ছে ব্যবহারকারীর ফোন, যা কম্পন রেকর্ড করেছে। লাল ডটটি ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র দেখায়। আর দুটি বৃত্ত – একটি হলুদ ও একটি লাল – দুটি ভিন্ন ধরনের ভূমিকম্প তরঙ্গ (P-Wave ও S-Wave) কে উপস্থাপন করে।
P-Wave (প্রাথমিক কম্পন) দ্রুত ছড়ায় কিন্তু কম ক্ষতিকর, আর S-Wave (দ্বিতীয় তরঙ্গ) ধীরে আসে কিন্তু সাধারণত বেশি ক্ষতি করে। এই তরঙ্গের গতিপথ ও ফোনগুলোর অবস্থানের উপর ভিত্তি করেই গুগল শনাক্ত করে কোথায় ও কখন সতর্কতা পাঠানো হবে।
ব্যবহারকারীর জন্য এর উপকারিতা বলতে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে,
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে ভূমিকম্প, হঠাৎ আসে এবং এক মুহূর্তেই বড় ক্ষতি করতে পারে। অল্প কিছু সেকেন্ডের আগাম সতর্কতা জীবন বাঁচাতে পারে। গুগলের এই সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ সেই কিছু সেকেন্ড আগে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারে, স্কুল বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাত্র ও রোগীদের সরিয়ে নিতে পারে এবং বড় বিপর্যয় কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হতে পারে।
এই Android Earthquake Alert System শুধু একটি প্রযুক্তিগত অর্জন নয়, বরং এটি প্রমাণ করে যে ভিড়ের তথ্য ব্যবহার করে কীভাবে বিশ্বব্যাপী বিপদ মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যায়। পৃথিবীর যত বেশি মানুষ অ্যান্ড্রয়েড(Android) ফোন ব্যবহার করবেন, ততটাই শক্তিশালী হবে এই সতর্কতা নেটওয়ার্ক।এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ।
এই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল, যদি এটি অন্যান্য দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া ব্যক্তি শনাক্ত ইত্যাদিতেও একদিন সহায়ক হতে পারে।ফলে হয়ত অনেক মানুষ প্রাণে বেচে যাবে।আশা করা যায় প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়নে একদিন সবই সম্ভব হবে।