যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA) দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মহাকাশ অভিযানে বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এই সংস্থার গবেষণা ও সাফল্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং গোটা মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু সম্প্রতি নাসা(NASA) এক বড় সংকটে পড়েছে।
নাসার একজন মুখপাত্র গতকাল শুক্রবার (৩১ জুলাই) জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ২০ শতাংশ কর্মী খুব শিগগিরই চাকরি ছেড়ে দেবেন বা ছাড়তে বাধ্য হবেন। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ৩ হাজার ৮৭০ জন কর্মী নাসা (NASA)থেকে বিদায় নেবেন। যদিও এই সংখ্যা এখনো চূড়ান্ত নয় পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে কিছুটা বাড়তেও বা কমতেও পারে।
মুখপাত্র আরও জানিয়েছেন, এই ছাঁটাইয়ের পর নাসার মোট কর্মীর সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৪ হাজার। এত বড় পরিমাণ ছাঁটাই নাসার ইতিহাসে খুব বিরল ঘটনা। ফলে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়েছে নাসার কর্মী, বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।
ইলন মাস্কের ‘ছাঁটাই সিদ্ধান্ত’ ও ট্রাম্পের প্রভাব
পলিটিকো ও দ্য গার্ডিয়ান–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ব্যাপক ছাঁটাইয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন বিখ্যাত ধনকুবের এবং ট্রাম্পের সাবেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইলন মাস্ক।
ইলন মাস্ক এক সময় “সরকারি খরচ কমানো” উদ্দেশ্যে তৈরি Government Efficiency Unit নামের একটি নতুন বিভাগে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেই সময় তিনি নাসার কর্মীদের একটি বিশাল অংশ ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করেন। যদিও পরে তিনি নিজেই এই বিভাগ থেকে পদত্যাগ করেন, কিন্তু তার নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে শুরু করে।
মাস্কের প্রভাব এখানেই শেষ নয়। এই পরিকল্পনার পর থেকেই ট্রাম্প প্রশাসন নাসার বাজেট কাটছাঁট করতে শুরু করে। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প এখন পর্যন্ত নাসার ১২ কোটি ডলার অনুদান বাতিল করেছেন।
বাজেট কমে যাচ্ছে, বন্ধ হচ্ছে অনেক মিশন
হোয়াইট হাউসের প্রস্তাব অনুযায়ী, আগামী বছরের জন্য নাসার মোট বাজেটের এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে দেওয়া হতে পারে। এই বাজেট কমিয়ে দেওয়ার প্রভাব পড়েছে নাসার অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মিশনে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অভিযান বাতিল করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে নাসার বিজ্ঞান গবেষণার বাজেটের প্রায় অর্ধেক কেটে নেওয়া হতে পারে। যদি সত্যি এমনটা ঘটে, তবে নাসার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে, এবং ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের প্রস্তুতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সাবেক-বর্তমান কর্মীদের খোলাচিঠি
এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে নাসার অনেক কর্মী মুখ খুলেছেন। সম্প্রতি নাসার প্রায় ৩০০ জন বর্তমান ও সাবেক কর্মী একটি খোলাচিঠি লিখেছেন সংস্থার অন্তর্বর্তী প্রধান শন ডাফিকে।
চিঠিটিতে চারজন মহাকাশচারীরও নাম রয়েছে, যারা আগে মহাকাশে অভিযান চালিয়েছেন। এই চিঠিটি উৎসর্গ করা হয়েছে মহাকাশ অভিযানে প্রাণ হারানো ১৭ জন নভোচারীকে, এবং এর শিরোনাম রাখা হয়েছে “The Voyager Declaration”।
চিঠিতে সরাসরি বলা হয়েছে, যদি এই ছাঁটাই, বাজেট কমানো ও আন্তর্জাতিক মিশন বাতিলের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, তবে এর ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে—শুধু নাসার জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য।
“পরিবর্তন হোক, তবে পরিকল্পিতভাবে”
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, নাসার মতো সংস্থায় কোনো বড় পরিবর্তন হঠাৎ করে আনা ঠিক নয়। যদি পরিবর্তন আনতেই হয়, তাহলে তা ধীরে ধীরে এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে হওয়া উচিত।
কিন্তু গত ছয় মাসে যেভাবে একের পর এক হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে নাসার কর্মীরা ভীত ও হতাশ হয়ে পড়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, এইসব পরিবর্তন শুধুমাত্র নাসার অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে দুর্বল করেনি, বরং এর প্রভাব পড়েছে বিজ্ঞান গবেষণা ও মিশনের সফলতার ওপরও।
“রাজনীতি নয়, বিজ্ঞান হোক অগ্রাধিকার”
সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে চিঠির লেখকরা বলেছেন, “যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব রাজনৈতিক লাভকে বিজ্ঞান ও মানুষের নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, তখন আমাদের চুপ থাকা উচিত নয়।”
তাঁদের মতে, বর্তমান বাজেট কাটছাঁট পরিকল্পনাহীন, এবং এটি কংগ্রেসের অর্থ বরাদ্দ–সংক্রান্ত আইন ভঙ্গ করছে। এর ফলে শুধু কর্মী ছাঁটাই নয়, নাসার ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলো ঝুঁকির মুখে পড়বে।
এমনকি শিক্ষার্থী ও তরুণ বিজ্ঞানীরা যারা নাসায়(NASA)কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের আগ্রহও কমে যেতে পারে। ফলে গোটা দেশের ভবিষ্যৎ উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে।
নাসার জন্য এটি শুধু সংকট নয়, সতর্কবার্তা
নাসার সাম্প্রতিক এই অবস্থা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সংকট নয়, বরং এটি এক ধরনের সতর্কবার্তা। এই সংস্থাটি যুগের পর যুগ ধরে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রভাগে থেকেছে। চাঁদের মাটিতে মানুষের পা ফেলা থেকে শুরু করে, মঙ্গলগ্রহে রোভার পাঠানো—সব কিছুর পেছনে রয়েছে নাসার অবদান।
আজ যদি সেই প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়ে, তবে তা আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। কারণ, এই গবেষণা, এই উদ্ভাবনই একদিন হয়তো আমাদের পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহে জীবন গড়ার পথ দেখাবে।
নাসার সামনে এখন বড় এক চ্যালেঞ্জ। শুধু কর্মী ছাঁটাই নয়, বরং এর পেছনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো আরও গভীরভাবে ভাবা দরকার। আমরা আশা করি, বিজ্ঞানকে সামনে রেখে এবং মানুষের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নীতিনির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নেবেন যাতে নাসা(NASA) তার গৌরবময় পথচলা অব্যাহত রাখতে পারে