আমরা অনেক সময় শুনে থাকি, “বজ্রপাত হচ্ছে, এখন ফোন ব্যবহার করো না”, বা “ফোনে কথা বললে বজ্রপাত হতে পারে”। বিশেষ করে গ্রামের বয়স্ক মানুষজন বা মা-বাবা এই কথাগুলো বলে থাকেন। অনেকে মনে করেন, বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে সেটি বিপজ্জনক হতে পারে, এমনকি ফোন বিস্ফোরণও ঘটতে পারে! কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি বজ্রপাতের সময় ফোন ব্যবহার বিপদজনক? নাকি এটি শুধুই একটি গুজব? আসুন, আজ এই বিষয়টি নিয়ে সহজভাবে আলোচনা করা যাক।
কেন এই ভয় বা ধারণা তৈরি হয়েছে?
অনেকেই মনে করেন মোবাইল ফোনে সিগন্যাল আসে “তরঙ্গের মাধ্যমে” এবং বজ্রপাতও এক ধরনের বিদ্যুৎ। তাই কেউ কেউ মনে করেন, বজ্রপাত হলে সেটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমাদের শরীরে এসে আঘাত করতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেন, ফোন ধাতব বস্তু হওয়ায় সেটি বিদ্যুৎ আকর্ষণ করে। এ থেকে ধারণা জন্মেছে, বজ্রপাত হলে ফোন ব্যবহার করা বিপদজনক হতে পারে।
বৈজ্ঞানিকভাবে কি হয়?
চলুন এখন দেখে নিই বিজ্ঞান কী বলছে।
মোবাইল ফোনের সিগন্যাল আসে রেডিও তরঙ্গ (radio waves) বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভের মাধ্যমে। এই তরঙ্গগুলো খুবই দুর্বল এবং এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ কখনোই যেতে পারে না। বজ্রপাত হলো প্রকৃতির একটি বিশাল বিদ্যুৎ নির্গমন প্রক্রিয়া, যা সাধারণত গাছ, উঁচু দালান, টেলিফোন টাওয়ার বা খোলা মাঠে থাকা উঁচু বস্তুতে আঘাত করে।
মোবাইল ফোন কোনোভাবেই এই বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে না, কারণ এটি একেবারেই ক্ষুদ্র এবং ব্যাটারিচালিত একটি যন্ত্র। এতে কোনো তার বা বাহ্যিক বিদ্যুৎ সংযোগ নেই যা বজ্রপাত টেনে আনতে পারে। তাই বজ্রপাত সরাসরি মোবাইল ফোনের ওপর আঘাত হানার কোনো বাস্তব বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
তাহলে গুজব কেন?
আসলে, অনেক সময় আমরা ভুলভাবে খবর বা ঘটনা শুনে ভুল ধারণা করে ফেলি। হয়তো কোথাও বজ্রপাতের সময় একজন ফোনে কথা বলছিলেন, আর দুর্ভাগ্যবশত তিনি বজ্রপাতে আহত বা নিহত হন। কিন্তু এটা প্রমাণ করা যায়নি যে ফোন ব্যবহারের কারণেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। বরং হয়তো তিনি খোলা মাঠে বা উঁচু স্থানে ছিলেন, যা বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
কখন ফোন বিপজ্জনক হতে পারে?
তবে, একটি ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি তারযুক্ত টেলিফোন ব্যবহারের সময়। যেমন: বাসায় যেসব ল্যান্ডফোন থাকে, যেগুলো তারের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে যদি সেই তারে বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎ এসে পড়ে, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ বিদ্যুৎ ওই তার ধরে ফোন সেটে এসে আঘাত করতে পারে।
কিন্তু মোবাইল ফোন যেহেতু ব্যাটারিচালিত ও তারবিহীন, তাই এই আশঙ্কা নেই।
বজ্রপাতের সময় কী করা উচিত?
বজ্রপাতের সময় শুধু ফোন ব্যবহার নয়, আরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত। যেমন:
খোলা মাঠ, উঁচু গাছপালা, খোলা ছাদ বা জলাশয়ের কাছাকাছি না যাওয়া ভালো।
যদি বাইরে থাকেন, তাহলে গাড়ির ভিতরে বা কোনো নিরাপদ ঘরের ভিতর আশ্রয় নিন।
বাড়ির ইলেকট্রনিক যন্ত্র (যেমন টিভি, ফ্রিজ, রাউটার) প্লাগ থেকে খুলে রাখা ভালো।
মাথার ওপরে ছাতা ব্যবহার না করাই ভালো, কারণ অনেক ছাতার ফ্রেম ধাতব হয়ে থাকে।
তাহলে ফোন ব্যবহার করবেন কি না?
হ্যাঁ, বজ্রপাতের সময় আপনি নিশ্চিন্তে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন, যদি আপনি নিরাপদ জায়গায় থাকেন। ঘরের ভেতরে বসে ইন্টারনেট চালানো, ভিডিও দেখা, কল করা বা মেসেজ আদান-প্রদান করায় কোনো বিপদ নেই।
বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, তবে ভুল তথ্য বা গুজবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মোবাইল ফোন বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে এ ধারণা একেবারেই ভুল ও ভিত্তিহীন। বিজ্ঞান বলছে, ফোনের তরঙ্গের মাধ্যমে বিদ্যুৎ যেতে পারে না। তাই আপনি যদি ঘরের ভেতরে থাকেন, তাহলে বজ্রপাতের সময় ফোন ব্যবহার করতে কোনো সমস্যা নেই।
তবে অবশ্যই, নিরাপদ স্থানে থাকা এবং অন্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বজ্রপাতের ঝুঁকি বেশি হয় খোলা বা উঁচু স্থানে, না যে ফোন ব্যবহারের কারণে।